নিষ্কাম কর্ম কি?



★★★নিষ্কাম কর্ম কি? --------------------------------------------------
সংখ্যরীতির দ্বিতীয় যুক্তি হল - যে জন্মায় সে মরবেই, যা অনিবার্য তার জন্য শোক  করা উচিত নয় । তাই গীতায় বলা আছে-
"জাতস‍্য হি ধ্রুবো মৃত্যুধ্রুবং জন্ম মৃতস‍্য চ।
তস্মদপরিহায‍্যে`হথে` ন ত্বং শোচিতুমহর্ষি।।"২/২৭

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরো বলেছেন ―"আমি ইহা দিগকে পূর্বেই মারিয়া রাখিয়াছি , হে অর্জুন তুমি নিমিত্ত মাত্র হও, যা অপ্রতি বিধেয়; যা অবশ্যই ঘটিবে তাহার জন্য শোক করিও না। যাহার প্রতিকার অসম্ভব ; তাহার জন্য শোক করা মূর্খের কাজ।"

জীব জগতের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে স্বকাম কর্ম বা কামনা নিয়ে কাজ করা হয়। যে কাজ ফল না দিয়ে বিনষ্ট হয় না।আর যে কর্ম ফল ভোগ করার জন্য জীবকে বার বার জন্ম গ্রহন করতে হয় এবং জাগতিক বস্তুর প্রতি আকর্ষণ হেতু দুঃখ ভোগ করতে হয়। ফলত এই রূপ কর্ম অনুষ্টানের দ্বারা জীবের কোনো দিনই মোক্ষ লাভ হয় না। এই রূপ কর্ম কে স্বকাম কর্ম বলে।

এখন প্রশ্ন হলো নিষ্কাম কর্ম কি ? নিষ্কাম কর্ম অর্থাৎ ফল ভোগের আকাঙ্খা বর্জিত কর্ম-মোক্ষ লাভের জনক হয়। নিষ্কাম আচরণের দ্বারা যখন প্রার্বদ্ধ বা সঞ্চিত কর্মের ফল ভোগ শেষ হয়, তখন একসময় জীব মোক্ষ লাভ করে। এই মোক্ষ লাভ কে নিষ্কাম কর্ম বলা হয় ।

আধ্যাত্মিক জীবনে দুটি পথ বা মার্গ আছে। যথা - (১) প্রবৃত্তি মার্গ এবং (2) নৃবৃত্তি মার্গ।
প্রবৃত্তি মার্গ হল ব্যক্তির লৌকিক জীবনের জন্য নির্দিষ্ট। এই জীবনে ব্যক্তির আকাঙ্খা, ব্যাক্তির অনুভূতি ইত্যাদি থাকে। এই মার্গ অনুযাই কর্ম হল , যা কামনা পূরণে সক্ষম। এই কামনা বা সক্ষম হলো দুই প্রকার যথা- (১) দৃষ্ট এবং (২) অদৃষ্ট।
অপর পক্ষে নৃবৃত্তি মর্গে সকল প্রকার আকাঙ্খা ও আকাঙ্খা প্রসূত কর্মের অবলুপ্তির কথা বলা হয়েছে । এই মর্গে লৌকিক পূরণের উদ্দেশ্য থাকে না। এই মর্গে জীবনের লক্ষ্য হল "আত্ম জ্ঞান' বা 'ব্রহ্ম জ্ঞান অর্জন'। এই রূপ আত্মজ্ঞান  অর্জন করা সম্ভব হলে আত্মা সকল প্রকার বন্ধন ছিন্ন করে তার শাশ্বত সার্বিক স্বতায় পুনরায় মুক্তি লাভে সামর্থ হয় । তবে অতীন্দ্রিয় স্বত্তার প্রকৃতি স্বরূপ উপলব্ধি করার জন্য নৈতিক জীবনে কর্তব্য গুলিতে প্রস্তুতি হিসাবে গন্য করা যেতে পারে । এই প্রসঙ্গে অদৈন্ত বৈদান্তি আচার্য শঙ্কর সাধন চতুষ্টয়ের উল্লেখ করেছেন।
   মনুসংহিতা ও গীতায় এই দুটি মার্গ ছাড়াও নিবৃত্তি মার্গ নামে একটি পৃথক মর্গের উল্লেখআছে। এই মার্গকে শঙ্কর প্রদত্ত প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি মার্গর সংশ্লেষণাত্মক বলা ও হয় ।
এই মার্গ অনুযাই জীবনের চুড়ান্ত পর্যায়ে নিত্য নৈমিত্তিক এবং কাম্য-কর্ম এই উভয় প্রকর কর্মের পরিসমাপ্তি হয় বলে মনে করা হয়। গীতায় এই তত্ত্বকে এক ধরণের শূন্যতা বলে মনে করা হয়েছে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে আদর্শটি  শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় প্রচারিত হয়েছে তা কর্ম যোগ নামে পরিচিত। গীতার কর্ম যোগ অনুসারে মানুষের জীবন হল  কর্মময়। গীতায় কর্ম বহু ক্ষেত্রে সাধারণ অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে- শ্বাস-প্রশ্বাস, আহার, নিদ্রা অর্থ-উপার্জন, যাগ-যোগ্য, সুকর্ম-কুকর্ম, সকলই কর্ম। এদের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস, আহার , নিদ্রা প্রভিতি কর্ম হল আবশ্যিক কর্ম এই সকল কর্ম ইচ্ছার দ্বারা ত্যাগ করা যায় না। কিন্তু এমন কর্ম আছে যা করা বা না করা- অথবা কর্ম করার পদ্ধতি নির্বাচন মানুষের ইচ্ছার অধীন। এই জন্য গীতায় বলা হয়েছে এই সকল কর্ম নির্বিচার করা উচিত নয়।

"ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত‍্যকর্মৎ।
কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজৈগুণৈঃ।।"৩/৫
অর্থাৎ বুদ্ধি যোগের দ্বারা বিহীত কর্ম নিধারণ করে নিয়ে যে কর্ম পাওয়া যায় সেই কর্ম হলো কর্তব্য কর্ম। মানুষ যদি স্বধর্ম অনুসারে কর্মানুষ্ঠান না করে, তাহলে সে জ্ঞান লাভ করতে পারে না। যে ব্যাক্তি কর্ম সম্পাদনে ভীত, সেই ব্যক্তি কখনো সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। সুতরাং তত্ত্ব জ্ঞান লাভ না হওয়ার জন্য বর্ণাশ্রম অনুসারে কর্ম ফল সকলকে অনুসরণ করতে হবে। "কোনো ব্যক্তি এক মুহূর্তের জন্য কর্মহীন অবস্থায় থাকতে পারে না। কারণ প্রকৃতির গুনে বাধ্য হয়ে সকলকে কাজ করতে হয়।"৩/৫

গুন ও কর্মের বিভাগ অনুসারে মনুষ্য সমাজে চারটি বর্ণ সৃষ্টি হয়েছে। যথা―
"চাতুব্বর্ণ‍্যং ময়া সৃষ্ট্যং গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।
তস‍্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ‍্যকর্তারমব‍্যয়ম্।।"৪/১৩

অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষৈত্রিয়, বৈশ‍্য ও শুদ্র- এদের কর্ম সমূহ স্বভাবজাত কর্মের দ্বারা বিভক্ত, মানুষ নিজ নিজ কর্ম সম্পাদন করে তার ব্যক্তিগত কল্যাণ ও সামাজিক কল্যাণ সিদ্ধ করার জন্য। নিজের নিদৃষ্ট কর্ম পরিত্যাগ করে অপরের কর্ম সম্পাদন করা উচিত নয় । পরের ধর্ম যতই ভালো রূপে অনুষ্টিত হোক না কেন , তার তুলনায় নিজ ধর্ম সর্ব দোষ মুক্ত বা শ্রেষ্ঠ।  স্বভাবিক গুনগত ধর্ম সম্পর্কে মনুষ্য পাপ ভোগ করে না। এই জন্য গীতায় বলা হয়েছে ―

"শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বভাবনিয়তং কর্ম্ম কুর্ব্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্।।"১৮/৪৭

কোন কোন কর্ম বিধেয় (করণীয়) গীতায় তার বৃস্তিত তালিকা নেই, প্রসঙ্গ ক্রমে কর্মে বিভিন্ন স্থানে কর্মের প্রকার ভেদ উল্লেখিত আছে । বস্তুতঃ বিহীত কর্ম বিষয়ে ধর্ম শাস্ত্রই প্রমান। কিন্তু বিহীত কর্ম করলে চলবে না । গীতায় কর্ম সম্পাদন পদ্ধতিও নিরূপিত হয়েছে। "অনাসক্ত হয়ে করণীয় কর্ম সম্পাদন করা উচিৎ।" এই আসক্তি হীন কর্মের কথাই গীতায় নানা স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। বস্তুতঃ "নিষ্কাম কর্মই গীতার মূল আদর্শ।" এই জন্য গীতায় নিষ্কাম কর্মবাদ প্রচারিত হয়েছে। এই নিষ্কাম কর্মই গীতার নৈতিক আদর্শ।

এই নৈতিক আদর্শের সাহায্যে মানুষের কাজের উচিত‍্য ও অনৌচিত‍্য বিচার করা হয়। কর্ম ফলের কথা চিন্তা না করে অনাসক্ত ভাবে কর্ম সম্পাদন করতে হবে। কর্ম ফল যেন কর্ম প্রকৃতির হেতু না হয়।

গীতায় কর্ম ফলের প্রতি উদাসিন হতে বলা হয়েছে, কিন্তু উদ্দেশ্য হীন ভাবে কর্ম করতে বলা হয়নি। নিষ্কাম কর্ম উদ্দেশ্য হীন কর্ম নয়। আবার গীতায় যোগস্থ হয়ে কর্ম সম্পাদন করার কথা বলা হয়েছে। যোগস্থ হয়ে কর্ম করার অর্থ হল ফলাঙ্খা ত্যাগ করে, সিদ্ধি ও অসিদ্ধিকে সমজ্ঞান করে কর্ম সম্পাদন করে। এই জন্য গীতায় বলা হয়েছে―
"কর্মণোব‍্যাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুভূর্মা  তে সঙ্গেহ স্তকর্মনি।।" ২/৪৭
..........সংগৃহিত

No comments

বাস্তুদোষ কাটান ।ও।বিদ্যা শিক্ষার উন্নতির জন্য বাড়িতে দক্ষিণা বর্তী শঙ্খ রাখুন উন্নতি আসবে।

বাস্তুদোষ কাটান ।ও।বিদ্যা শিক্ষার উন্নতির জন্য বাড়িতে দক্ষিণা বর্তী শঙ্খ রাখুন উন্নতি আসবে। https://youtu.be/fFBQjxcQzxc https://youtu....

Theme images by RBFried. Powered by Blogger.